আজ শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এর জন্মদিন
~~~~~~~~~
বিনম্র শ্রদ্ধা ও স্বরণ
(২৬ অক্টোবর ১৮৭৩ — ২৭ এপ্রিল ১৯৬২)

আবুল কাশেম ফজলুল হক বাঙালি রাজনীতিবিদ। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাঙালি কূটনীতিক হিসেবে পরিচিত লাভ করেন। রাজনৈতিক মহল এবং সাধারণ মানুষের নিকট শেরে বাংলা এবং ‘হক সাহেব’ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি রাজনৈতিক অনেক পদে অধিষ্ঠান করেছেন, তার মধ্যে কলকাতার মেয়র (১৯৩৫), অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী (১৯৩৭-১৯৪৩), পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী(১৯৫৪), পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (১৯৫৫), পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর (১৯৫৬-১৯৫৮) অন্যতম। যুক্তফ্রন্ট গঠনে প্রধান নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। কৃষক সম্প্রদায়ের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিলো খুবই গভীর।
এ. কে. ফজলুক হক (পাকিস্তানের প্রকৃত স্থপতি) ১৮৭৩ সালে ২৬ অক্টোবর বরিশাল জেলার রাজাপুর থানার সাতুরিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আদি পৈতৃক নিবাস পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলায়। তিনি কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ এবং সাইদুন্নেসা খাতুনের একমাত্র পুত্র ছিলেন।
এ কে ফজলুক হকের প্রাথমিক শিক্ষা বাড়িতেই শুরু হয়। পরে তিনি গ্রাম্য পাঠশালায় ভর্তি হয়েছিলেন। গৃহ শিক্ষকদের কাছে তিনি আরবি, ফার্সি এবং বাংলা ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। ১৮৮১ সালে তিনি বরিশাল জিলা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৮৮৬ সালে অষ্টম শ্রেণিতে তিনি বৃত্তি লাভ করেন এবং ১৮৮৯ সালে ফজলুল হক প্রবেশিকা পরীক্ষায় তৎকালীন ঢাকা বিভাগে মুসলমানদের মধ্যে প্রথম স্থান দখল করেন। ফজলুল হক তাঁর প্রখর স্মৃতিশক্তির কারণে শিক্ষকদের খুবই স্নেহভাজন ছিলেন। প্রবেশিকা পাশ করার পর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্যে তিনি কলকাতায় যান। ১৮৯১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ এ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। সে সময় প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। মেধা ও প্রতিভাগুণে তিনি প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এফ এ পাশ করার পর তিনি গণিত, রসায়ন ও পদার্থ বিদ্যায় অনার্সসহ একই কলেজে বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হন। ১৮৯৩ সালে তিনি তিনটি বিষয়ে অনার্সসহ প্রথম শ্রেণিতে বি.এ. পাশ করেন। বি.এ. পাশ করার পর এম.এ. ক্লাসে প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন ইংরেজি ভাষায়। পরীক্ষার মাত্র ছয় মাস আগে তাঁকে এক বন্ধু ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন যে, মুসলমান ছাত্ররা অংক নিয়ে পড়ে না, কারণ তারা মেধাবী নয়। এই কথা শুনে এ কে ফজলুক হক প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে, অংকশাস্ত্রেই পরীক্ষা দেবেন। এরপর, মাত্র ছয় মাস অংক পড়েই তিনি প্রথম শ্রেণি লাভ করেন।

মুসলিম লীগে যোগদানঃ

১৯৪৬ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গীয় আইন পরিষদের নির্বাচনে বরিশাল অঞ্চল ও খুলনার বাগেরহাট অঞ্চল থেকে নির্বাচিত হন। কিন্তু, দলীয়ভাবে পরাজিত হলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রীসভা গঠন করেন ও বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই নির্বাচনের পর দলীয় নেতাকর্মীদের চাপে হক সাহেব মুসলিম লীগে যোগ দেন। কিন্তু দলের সদস্য হিসেবে তিনি ছিলেন নীরব।

পাকিস্তান আমলে রাজনীতিঃ

পাকিস্তান গঠিত হবার পর থেকে হক সাহেব ঢাকা হাইকোর্টে পুনরায় আইন ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তিনি ঢাকা হাইকোর্ট বারের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫১ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাটর্নি জেনারেল নিযুক্ত হন। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে এ কে ফজলুল হক সমর্থন দেন।

কৃষক শ্রমিক পার্টি গঠনঃ

১৯৫৩ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের সময় তাঁর বাসভবনে কৃষক-প্রজা পার্টির কর্মীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে দলের নাম থেকে ‘প্রজা’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘কৃষক শ্রমিক পার্টি’ গঠন করা হয়। আবদুল লতিফ বিশ্বাসকে সাধারণ সম্পাদক করে এই পার্টির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এ কে ফজলুক হক।

যুক্তফ্রন্ট গঠনঃ

১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর এ কে ফজলুক হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে নিয়ে গঠিত হলো যুক্তফ্রন্ট। যুক্তফ্রন্টের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করার জন্য এ সময়ে সাপ্তাহিক ‘ইত্তেফাক’ -কে দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তর করা হয়। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ছিলেন ইত্তেফাক -এর প্রতিষ্ঠা সম্পাদক। ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ ৯টি আসন লাভ করে। ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল এ কে ফজলুক হক চার সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রীসভা গঠন করেন। পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী পরিষদ গঠন করা হয় ১৫ মে। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক।

পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হকঃ

যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি ছিলো। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীপরিষদ এই ২১ দফা বাস্তবায়নের জন্য তৎপর হন। তাদের গৃহীত উল্লেখ্যযোগ্য কর্মসূচিগুলো হলোঃ
বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ।
২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা।
ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতিতে ‘শহীদ মিনার’ নির্মাণ।
বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বর্ধমান হাউসকে বাংলাভাষা গবেষণা কেন্দ্র বা বাংলা একাডেমি ঘোষণা করা।
জমিদারি ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদের ব্যবস্থা নেওয়া।
এই সময়ে এ কে ফজলুক হক কলকাতা সফরে যান। ১৯৫৪ সালের ৩১ মে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রী পরিষদ বাতিল করে দিয়ে ৯২(ক) ধারা জারির মাধ্যমে প্রদেশে গভর্নরের শাসন প্রবর্তন করেন।

১৯৫৫ এর নির্বাচনঃ

১৯৫৫ -এর ৫ জুন সংখ্যাসাম্যের ভিত্তিতে পুনরায় গণপরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। মুসলিম লীগের চৌধুরী মোহাম্মদ আলী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন। এ কে ফজলুল হক ছিলেন এই সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন বিরোধী দলের নেতা।

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরঃ

১৯৫৬ -এর ২৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র গৃহীত ও ২৩ মার্চ তা কার্যকরী হয়। এ সময় এ কে ফজলুক হক পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ৮৩ বছর বয়সে করাচি থেকে ঢাকা এসে ১৯৫৬ সালের ২৪ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সালের ১ এপ্রিল পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে গভর্নরের পদ থেকে অপসারণ করে। এরপর তিনি তাঁর ৮৬ বছরের বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক জীবন থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।

সূত্রঃ ইউকিপিডিয়া।

Leave a comment

Design a site like this with WordPress.com
Get started